ঐতিহাসিক ‘ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’ স্বাক্ষর

Spread the love

পরাধীনতার গ্লানি মুছে ব্রিটেনে ‘মোদী ম্যাজিক’ দেখালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বহু প্রতীক্ষিত ‘ঐতিহাসিক ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল এবং ব্রিটেনের বাণিজ্যমন্ত্রী জোনাথন রেনল্ডস, দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি স্বাক্ষরের পরই দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘ইউকে-ইন্ডিয়া ভিশন ২০৩৫’ নামে একটি নতুন কৌশলগত নথি প্রকাশ করেন, যা ভবিষ্যতের অংশীদারিত্বের রূপরেখা স্থির করবে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বর্তমানে ২ দিনের সফরে ব্রিটেনে রয়েছেন। ব্রিটেনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরেই ওঠে ‘মোদী-মোদী’ স্লোগান। মোদীর এই সফরে দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের বিরাট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন চেকার্সে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য ও অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে আলোচনা হয়। এই সময় ভারত-ব্রিটেনের মধ্যে ঐতিহাসিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ‘মাইলফলক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক দিন। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে কয়েক বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর, আজ আমাদের দুই দেশ একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।’ অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইইউ ত্যাগের পর এটি ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই চুক্তি উভয় দেশের জন্যই অনেক সুবিধা বয়ে আনবে। এই চুক্তি কাজের মজুরি বৃদ্ধি করবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং কর্মজীবী মানুষের পকেটে আরও অর্থ জোগান দেবে।’ তাঁর কথায়, ‘এটি চাকরি এবং ব্যবসা– উভয়ের জন্য উপকারী। এটি বাণিজ্যকে সস্তা, দ্রুত এবং সহজ করে তুলবে। এফটিএ-র অধীনে, অনেক পণ্যের উপর শুল্ক বাতিল করা হয়েছে, যা ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে বাণিজ্যের পথকে আগের চেয়ে সহজ এবং আরও লাভজনক করে তুলবে।’

ব্রিটেনের ব্যবসা ও বাণিজ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যের ওপর গড় শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে নেমে ৩ শতাংশে দাঁড়াবে। এর ফলে ব্রিটিশ সংস্থাগুলির জন্য ভারতীয় বাজারে সফট ড্রিংকস, প্রসাধনী, গাড়ি এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি রফতানি সহজ হবে। বিশেষভাবে উপকৃত হবে হুইস্কি নির্মাতারা। আগে যেখানে শুল্ক ছিল ১৫০ শতাংশ, তা প্রথমে কমে দাঁড়াবে ৭৫ শতাংশ এবং আগামী ১০ বছরে আরও কমে ৪০ শতাংশে নেমে আসবে। এতে ব্রিটেনের জন্য ভারতীয় বাজারে প্রতিযোগিতার সুবিধা তৈরি হবে। এফটিএ ৯০ শতাংশ শুল্ক লাইন বাতিল করে প্রায় ১০০ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক উন্মুক্ত করে তুলবে। এর ফলে বস্ত্র, চামড়া এবং জুতোর মতো শ্রম-নিবিড় পণ্য ব্রিটেনের ২৩ বিলিয়ন ডলারের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। ভারতের মহিলা তাঁতি এবং ডিজাইনাররা এখন বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলির প্রতিযোগিতা বাজারে সমান সুযোগ পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

ভারতীয় কৃষকেরা এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ, ভারতের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যগুলি এখন ব্রিটিশ বাজারগুলিতে শুল্ক মুক্ত ভাবে পাওয়া যাবে। হলুদ, গোলমরিচ, এলাচ, আমের পিউরি, আচার, ডাল ও অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাবার ব্রিটেনে শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ পাবে। ফলে রপ্তানিকারকদের মার্জিন বাড়বে এবং বিদেশি বাজারে ভারতের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বাড়বে।ফল, সবজি, সিরিয়াল, মিশ্র মসলা, প্যাকেটজাত খাবার, রেডি-টু-ইট খাবার-সহ ৯৫ শতাংশ পণ্যে শুল্ক থাকবে না। এতে ব্রিটেনে এই পণ্যের চূড়ান্ত দাম কমবে, এবং ভারতীয় পণ্য সুপারমার্কেট ও এথনিক স্টোরে সহজেই প্রবেশ করতে পারবে।ব্রিটেন-ভিত্তিক সংস্থাগুলি যেমন অ্যাস্টন মার্টিন এবং জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (টাটা মোটরসের মালিকানাধীন)-এর মতো ব্রিটিশ বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতারা উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এছাড়াও চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ভারতীয় পেশাজীবীদের জন্য ভিসা ও কাজের নিয়ম শিথিল করা। এর ফলে প্রতিবছর ৬০,০০০-এরও বেশি আইটি পেশাদার উপকৃত হবেন বলে বাণিজ্য মন্ত্রক আশা করছে। ব্রিটেনে কর্মরত ভারতীয় পেশাদাররা তিন বছর পর্যন্ত সামাজিক নিরাপত্তা অবদান থেকে অব্যাহতি পাবেন। এর ফলে বার্ষিক চার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।ব্রিটেন ভারতীয় যোগ প্রশিক্ষক, রাঁধুনি, সঙ্গীতজ্ঞ এবং অন্যান্য চুক্তিভিত্তিক পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য অস্থায়ী প্রবেশাধিকার প্রদান করবে।পাশাপাশি ব্রিটেনের সংস্থাগুলিকে ভারতে ২০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের অসংবেদনশীল ফেডারেল সরকারি ক্রয় টেন্ডারে দরপত্র জমা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। এর ফলে প্রতি বছর প্রায় ৪.০৯ লক্ষ কোটি টাকার প্রায় ৪০ হাজার দরপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে ব্রিটেনের অনুমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *