বুদ্ধদেববাবু স্বর্গে শান্তিতে থাকুক চান না তিনি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণ হল যুগের অবসান।বাংলায় এক নক্ষত্রপতন। তাঁর মতন সৎ,আদর্শবান, শিক্ষিত নেতা আজ পর্যন্ত বাংলায় নেই এমনটাই মত অধিকাংশ বাঙালির। তাঁর প্রয়াণে গভীরভাবে শোকাহত গোটা পশ্চিমবঙ্গবাসী।গতকাল এমন লোক খুবই কম ছিল, যাদের সোশ্যাল মিডিয়া স্ট্যাটাসে বুদ্ধদেবের চলে যাওয়ার আফসোস নেই। প্রায় প্রত্যেকেই তাঁর ছবি দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন জানিয়েছেন। বামফ্রন্টের নাম গন্ধ বাংলা থেকে মুছে গেলেও বাম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সততার কথা কেউ ভোলেননি। তবে এরই মাঝে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসলেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তিনি লেখেন, ‘বলতে পারছি না চিরশান্তিতে থাকুন’। কেন হঠাৎ বুদ্ধদেবের উপর এত রাগ তসলিমা নাসরিনের? ঠিক কি লিখেছেন তিনি?
তিনি লেখেন, ‘২০০২ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সখ্য ছিল। তারপর তাঁর কী হলো কে জানে, ২০০৩ সালে বলা নেই কওয়া নেই আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি তিনি নিষিদ্ধ করলেন। সেদিনই মনে হয়েছিল আমি তাঁর চেয়ে খাঁটি বামপন্থী। আমি নাস্তিক, আমি নারীবাদী, আমি ধর্ম বর্ণ শ্রেণী লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমতা এবং সমানাধিকারে বিশ্বাস করি। একটি মৌলবাদি দেশে কিশোর বয়স থেকে আমার আদর্শের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করছি। আমার দ্বিখণ্ডিত বইটিতে আমি রাষ্ট্রের কোনওরকম ধর্ম থাকার বিরুদ্ধে লিখেছিলাম। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করার জন্য লিখেছিলাম বলে তিনি আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলেন। ভাবা যায়, একজন বড় বামপন্থী নেতা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা সমর্থন করতে চান। যুক্তি দেন, তা না হলে মুসলমানরা রাগ করবে’। লেখিকা আরও জানান, ‘হাইকোর্টে কলকাতার মানবাধিকার সংস্থা এপিডিআর দ্বিখণ্ডিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা করলো। জয়ী হলো। দ্বিখণ্ডিত থেকে বুদ্ধবাবুর জারি করা নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। তিনি আমার ওপর আগুন হয়ে রইলেন রেগে। আরে মামলা তো আমি করিনি, জয়ী তো আমি হইনি, সুজাত বাবুরা হয়েছে। এরপর থেকেই আমাকে দেশ থেকে, সম্ভব না হলে কলকাতা থেকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। ২০০৭ সালে আমাকে সাড়ে চারমাস গৃহবন্দি রেখেছিলেন, যেন অতিষ্ট হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু কোথাও যাইনি আমি। শেষ পর্যন্ত একটা কুৎসিত নাটক করে তাড়িয়েছিলেন।’
১১ বছর মুখ্যমন্ত্রী থেকেও কোনও বড় ঘরে শিফট হননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।তাঁর কাছে পাম অ্যাভিনিউয়ের দু-কামরার ছোট্ট, স্যাঁতস্যাতে ঘরই ছিল তাঁর স্বর্গ। এই বাড়ি ছেড়ে অসুস্থ শরীরে হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে চাইতেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বরাবর সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত তিনি। অনাড়ম্বরভাবে বাঁচতে ভালোবাসতেন, তাই তো চার দশক ধরে পাম অ্যাভিনিউয়ের এই ঘরেই থাকতেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
অসুস্থতার জেরে বাড়িতেই তৈরি হয়েছিল হাসপাতালের সেট-আপ। অক্সিজেন মেশিন, ওষুধপত্র ভর্তি। তার মাঝে দু-চোখ তুলে তাকালে শুধু বই আর বই। আসলে তাঁর অন্তর জুড়ে ছিল শুধুই সাহিত্য। আদ্যোপ্রান্ত সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। গীতবিতান থেকে বিষ্ণু দে-র কবিতা, ইংরেজি সিনেমার বই থেকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাস বই, তাঁর সংগ্রহে রয়েছে অন্নদাশঙ্কর রায়, শামসুর রহমান। নিজের লেখা বইও রয়েছে সেই ঘরে। শেষ বয়সে চোখে তেমন দেখতে পেতেন না। স্ত্রী, মীরা ভট্টাচার্য প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়ে শোনাতেন। দেশ-দুনিয়ায় কোথায় কী ঘটছে সব খবর নিতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে ভালোবাসতেন। অন্য গানে বিশেষ রুচি ছিল না। ঘরের দেওয়াল জুড়ে লেলিন, কার্ল মাক্সসের ছবি-মূর্তি। কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছবিও দেওয়ালে ঝোলানো। পাশে চার্লি চ্যাপলিনের ছবি। এই বাড়ি ছিল বুদ্ধদেবের প্রাণের চেয়েও প্রিয়।