মূত্রনালির সংক্রমণ! লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার

Spread the love

গরমের সময় সবচেয়ে বেশি যে রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে তা হলো প্রস্রাবে সংক্রমণ বা ইউটিআই। ইংরেজি ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ইউটিআই। এই রোগটি সাধারণত মূত্রনালির এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ।

ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে যখন মূত্রনালির নিম্নাংশ আক্রান্ত হয় তখন চিকিৎসাশাস্ত্রে এই পরিস্থিতিকে বলা হয় মূত্রথলির সংক্রমণ বা সিস্টাইটিস আর মূত্রনালির ঊর্ধ্বাংশ আক্রান্ত হলে তাকে কিডনির সংক্রমণ বা পায়েলোনেফ্রাইটিস বলে ধরে নেন বিশেষজ্ঞরা।

নারী কিংবা পুরুষ উভয়ই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ঠিক কী কারণে প্রসাবের ইনফেকশন হতে পারে এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক হাসিনাতুল জান্নাত বলেন, দীর্ঘ সময় প্রসাব আটকে রাখার কারণে নারী ও পুরুষ উভয়কেই এই সমস্যায় পড়তে হয়, যা পরবর্তীতে মূত্রনালির সংক্রমণসহ নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করে।

লক্ষণ

ইউটিআই সমস্যায় বেশকিছু লক্ষণ রোগীর শরীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ রোগের কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো

১. ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা, কিন্তু কোনোবারই যথেষ্ট পরিমাণ প্রস্রাব হবে না।

২. প্রস্রাব করার সময় তীব্র ব্যথা এবং জ্বালাপোড়া অনুভব হবে।

৩. শরীর দুর্বল হওয়া, পিঠের নিচের দিকে বা তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হওয়া।

৪. ঘোলা ও দূর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব হওয়া বা কখনো কখনো প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া।

৫. প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ভাবের সাথে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে।

৬. প্রস্রাব আটকে রাখতে না পারা।

৭. ছোটদের ক্ষেত্রে ডায়ারিয়া, জ্বর, খেতে না চাওয়া ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা যায়।

৮. প্রস্রাবের রাস্তায় চুলকানি হওয়া ইত্যাদি।

এসব উপসর্গ দেখলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

এই অসুখ থেকে দূরে থাকার উপায়/প্রতিকার

১. নিয়ম মেনে শরীরে যতটা পানির প্রয়োজন, ততটাই জল খেতে হবে। যত বেশিবার মূত্র নির্গত হবে, ততই শরীর থেকে টক্সিন বের হবে। এতে মূত্রথলিতে জীবাণুর বাসা বাধার শঙ্কাও কমে।

২. জলের পাশাপাশি তরল খাবার যেমন ফলের জুস, ডাবের জল ইত্যাদি বেশি বেশি পান করুন।

৩. পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখবেন সেটি পরিষ্কার কি না। হাই কমোড ব্যবহারের সময় সেটা জল দিয়ে ধুয়ে নেবেন, যদি সম্ভব না হয় তাহলে কমোডের ওপর টিস্যু পেপার বিছিয়ে নেবেন এতে করে জীবাণু সহজে আপনার শরীরের সংস্পর্শে আসতে পারবে না।

৪. একই কাপড় না ধুয়ে বেশিদিন পরিধান করা থেকে বিরত থাকুন। প্যান্টি নিয়মিত ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ অনেকদিন যাবত না ধুয়ে ব্যবহার করলে তাতে জীবাণু বাসা বাধে এবং সংক্রমণ হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়।

৫. প্রতিদিন দু’বেলা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে বিশেষ কোনো জেল বা সাবান দিয়ে গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করুন।

৬. প্রস্রাবের পর যৌনাঙ্গ ভালো করে ধুয়ে নিন। মনে রাখবেন, যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করার সময় সবসময় সামনে দিক থেকে পেছনে যাবেন, পেছন থেকে সামনে নয়। তা না হলে মলদ্বার থেকে জীবাণু সামনে চলে এসে সংক্রমণের ভয় থাকে।

৭. যখনই প্রস্রাবের বেগ আসবে সাথে সাথে প্রস্রাব করে ফেলুন, আটকে রাখবেন না।

৮. সহবাসের পরে অবশ্যই বাথরুমে যান। ব্লাডার খালি করে দেয়াই ভালো। কেননা ইন্টারকোর্সের সময় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের শঙ্কা অনেকাংশে বেড়ে যায়। সেখান থেকে বিভিন্ন ইনফেকশন হতে পারে। এছাড়াও সেক্সের সময় ব্যবহৃত গর্ভনিরোধ থেকেও সংক্রমণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

৯. সর্বপোরি পার্সোনাল হাইজিন বা ব্যক্তি জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একবার ইউটিআই হয়ে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া উপায় থাকে না। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে রোগীকে সুস্থ করে তোলে। তবে, ওষুধ খাওয়ার আগে পরিপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীই খাওয়া উচিত।

মনে রাখবেন, এই রোগটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি জীবনের লাইফস্টাইলের উপর নির্ভরশীল। এতে প্রথম দিকে তেমন কোনো সমস্যা না হলেও বারবার হতেই থাকলে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে যে কারো জীবনে। তাই সময় থাকতেই নিজের যত্নে সচেতন হন।

ইউটিআই কেন হয়/ কারণ?

ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা অনেক বেশি দেখা যায়। কারণ মেয়েদের মূত্রনালি জন্মগতভাবে পুরুষদের তুলনায় ছোট এবং মলদ্বারের খুব কাছাকাছি। তাই ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই আক্রমণ করে এবং জীবাণু মূত্রথলি এবং কিডনির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তবে ছেলে মেয়ে উভয়েরই এ রোগে আক্রান্তের বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে-

১. ইস্ট্রোজেন মূত্রনালির সংক্রমণে বাধা দেয়। মেনোপজ-এর পর ইস্ট্রোজেন-এর ক্ষরণ কমে যায়। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।

২. অনেকক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখলে সংক্রমণ হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়। টেলিভিশন দেখার সময়, বাসে ট্রেনে যাতায়াত করার সময় বা জরুরি মিটিং-এর সময় অনেকেই প্রস্রাব আটকে রাখেন যা একদমই উচিত নয়।

৩. যৌনসঙ্গীর ইউটিআই থাকলে শারীরিক মিলনের সময় অন্য সঙ্গীও সংক্রমিত হতে পারেন।

৪. পারসোনাল হাইজিন বা নিজস্ব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে না চললে ইউটিআই হতে পারে।

৫. যদি কারো কিডনি অথবা মূত্রথলিতে পাথর থাকে তবে তা স্বাভাবিক মূত্রত্যাগে বাধা প্রদান করে। এর ফলেও ইনফেকশন হতে পারে।

৬. ডায়াবেটিস, প্রেগন্যান্সি বা অন্য কোনো রোগে যদি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে থাকে তাহলে ইউটিআই হতে পারে।

৭. অনেক সময় অপারেশনের আগে বা পরে রোগীদের ক্যাথেটার পড়ানো হয়। বেশিদিন ক্যাথেটার পরানো থাকলে খুব সহজেই ইউটিআই হতে পারে।

ইউটিআই-এর ফলে ঝুঁকি

১. সঠিক সময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা না করালে একই সমস্যা বারবার হতে পারে।

২. মূত্রনালি থেকে ইনফেকশন কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।

৩. বারবার হলে কিডনি ঠিকমতো কাজ করে না। যেখান থেকে পাইলোনেফ্রাইটিস-এর মতো জটিল সমস্যা দেখা দেয়।

৪. গর্ভাবস্থায় ইউটিআই হলে সময়ের আগেই ডেলিভারি হয়ে যাওয়া, কম ওজনের বাচ্চা জন্ম দেয়া, এমনকি গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে।

৫. অনেক সময় ইনফেকশনের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তা রক্তে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *