ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাজুড়ে হাজার হাজার বেসামরিক আবাসিক ভবন ধ্বংস করেছে ইসরাইল। এটা শুরু হয় মূলত চলতি বছরের মার্চ মাসে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে দেয়ার পর। এক সময় যেগুলো ছিল লাখো মানুষের বাড়ি, গত কয়েক সপ্তাহে তা আক্ষরিক অর্থে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।বেশ কিছু এলাকায় ব্যাপক আকারের ধ্বংসযজ্ঞ স্যাটেলাইট চিত্রে উঠে এসেছে। ইসরাইলের সামরিক কমান্ড এসব এলাকাকে তাদের নিয়ন্ত্রাধীন বলে দাবি করেছে।
এসব এলাকার আবাসিক ভবনের বিশাল একটা অংশ পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের মাধ্যেমে ধ্বংস করা হয়েছে। এসব ভবনের মধ্যে গত দুই বছরের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন যেমন ছিল, তেমনি একেবারেই অক্ষত ভবনও ছিল।
এসব ভবন ধ্বংসের অনেক ভিডিও গত কয়েক সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিবিসি ভেরিফাই’র যাচাইয়ে এসব ভিডিওর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, ইসরাইলি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে বহুতল ভবন, স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস করছে। দেখা যায়, বিস্ফোরণের পরপরই প্রচণ্ড শব্দে ধোয়া ও ধুলো আকাশে উঠে যাচ্ছে।
বিবিসি ভেরিফাই জানিয়েছে, একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, গাজায় এসব ভবন ধ্বংসের মাধ্যমে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে ইসরাইল যুদ্ধাপরাধ করে থাকতে পারে। কারণ জেনেভা কনভেনশনে কোনো দখলদার শক্তির পক্ষে কোনো এলাকায় অবকাঠামো ধ্বংস একেবারেই নিষিদ্ধ।
যদিও ইসরাইল বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ইসরাইলি বাহিনীর (আইডিএফ) একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনেই অভিযান চালিয়েছে। তাদের দাবি, হামাস গাজার বেসামরিক এলাকায় ‘সামরিক রসদ’ লুকিয়ে রেখেছে এবং ‘ভূসম্পত্তি বা ঘরবাড়িরধ্বংস কেবল তখনই করা হয় যখন সামরিকভাবে জরুরি হয়ে পড়ে।’

কিন্তু ইসরাইলি বাহিনীর এই দাবির সঙ্গে বাস্তবতার তেমন মিল নেই বললেই চলে। মিশর সীমান্তের কাছে রাফাহ শহরে ধ্বংসের মাত্রা দেখলে তা সহজেই স্পষ্ট হয়। রাফাহর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অসংখ্য ভবন পরিকল্পিতভাবে ও নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদ কোরি শের এবং জ্যামন ভ্যান ডেন হোয়েকের ক্ষয়ক্ষতির এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এপ্রিল থেকে গাজায় যত ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ, খননকারী যন্ত্র আর বুলডোজার ব্যবহার করে পুরো এলাকা কার্যত সমান করে ফেলা হয়েছে।
এই এলাকায় এখন যেদিকেই তাকানো হয়, সেদিকেই শুধু ধু ধু মরুভূমির মতো দেখা যায়।চলতি জুলাই মাসে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ রাফাহর ধ্বংসাবশেষের উপর তথাকথিত ‘মানবিক শহর’ প্রতিষ্ঠার রূপরেখা প্রকাশ করেছেন, যেখানে প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে আটকে রাখা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই পরিকল্পনা সামনে আসার পর চারদিকে নিন্দার ঝড় বইছে। ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেন, এই পরিকল্পনাকে ‘একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ বলে ব্যাখ্যা করা যায়।
ইসরাইল দাবি করেছে, গাজা উপত্যকার বিশাল এলাকায় তাদের সেনাবাহিনীর ‘নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে, যেগুলো এখন সামরিক অঞ্চল অথবা অধিবাসীদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব এলাকায় গত মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে ৪০টি স্থানে অবকাঠামো ভেঙে ফেলার ফুটেজ শনাক্ত করেছে বিবিসি ভেরিফাই।
এসব ভিডিও ফুটেজের মধ্যে কয়েকটি শুক্রবার (১৮ জুলাই) বিবিসির এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। যার মধ্যে রাফাহ শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত তেল আল সুলতান এলাকায় অবস্থিত স্কুল ভবন, আবাসিক ও সরকারি ভবনও রয়েছে।
তেল আল সুলতান রাফা শহরের সবচেয়ে প্রাণবন্ত এলাকাগুলোর একটি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটির রাস্তা বরাবর ছিল শহরের একমাত্র বিশেষায়িত প্রসূতি হাসপাতাল, এতিমখানা ও পরিত্যক্ত শিশুদের যত্ন নেয়ার জন্য একটি কেন্দ্র।
স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, এই এলাকার অধিকাংশ ভবন ইসরাইলি বিমান হামলায় আগেই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ব্যাপক বোমাবর্ষণের পরও কয়েক ডজন ভবন দাঁড়িয়ে ছিল। তবে গত ১৩ জুলাই নাগাদ পুরো এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র একটি হাসপাতাল আর কয়েকটা ভবন এখনও আছে।
এখন রাফাহর সৌদিপাড়া সংলগ্ন এলাকায় ধ্বংস চলছে। পাড়াটিতে বড় বড় বেশ কয়েকটি মসজিদ ও স্কুল রয়েছে যা এখন ধ্বংসের ঝুঁকির মুখে। এরই মধ্যে ইসরাইলি বুলডোজার ও ট্যাংকের উপস্থিতি দেখা গেছে। যা একটি ভিডিওতে ধরা পড়েছে, রাস্তার পাশে খননযন্ত্র দিয়ে ভবন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরাইলি সেনারা।
ইসরাইলের এই ঢালাও ধ্বংসযজ্ঞ অসহায় চোখে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই অধিবাসীদের। আছে শুধুই হাহাকার। তেল আল সুলতান এলাকার বাসিন্দা মুয়াতাজ ইউসুফ আহমেদ আল আবসি তার নতুন বাড়িটি হারিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, ‘যুদ্ধ শুরুর মাত্র এক বছর আগে আমি আমার নতুন ঘরে উঠেছিলাম। ভবিষ্যৎ নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। আমার সেই ঘর আর নেই, কোনো আশ্রয়ও নেই।
গাজা উপত্যকার অন্যান্য অংশেও ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞ দৃশ্যমান, যা গত যুদ্ধের মধ্যে বোমা হামলার সময় ভারি ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পারলেও এখন ধ্বংস করা হচ্ছে। গাজা সীমান্ত থেকে মাত্র ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কৃষিনির্ভর শহর খুজা’আ এলাকাতেও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
টমেটো, গম ও জলপাই চাষের জন্য বিখ্যাত এই শহরের ১২০০টিরও বেশি ভবন এরই মধ্যে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইসরাইলি বাহিনীর দাবি, ধ্বংস করা ভবনগুলো ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’র অংশ। পাশের শহর আবাসান আল-কবিরা, যেখানে যুদ্ধের আগে প্রায় ২৭ হাজার মানুষের বাস ছিল, সেখানেও মে ও জুলাইয়ের মধ্যে মাত্র ৩৮ দিনে একটি বিশাল এলাকা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।