জাতিগত হিংসার আগুনে পুড়ছে মণিপুর। এই আবহে সম্প্রতি একটি অডিয়ো ক্লিপ প্রকাশ্যে এসেছে, যাতে দাবি করা হচ্ছে, এন বীরেন সিং নিজেই বলছেন যে তাঁর কথায় রাজ্যে জাতিগত হিংসা শুরু হয়। এবার সেই অডিয়ো ক্লিপের ফরেন্সিক পরীক্ষা করার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবকে এই পরীক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমার মুখবন্ধ খামে এই সংক্রান্ত রিপোর্ট তলব করেছেন। এরই সঙ্গে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টেই শোনা হবে, নাকি তা মণিপুর হাই কোর্টে যাবে, তা নিয়েও সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। উল্লেখ্য, দাবি করা হচ্ছে, এই অডিয়ো ক্লিপটি বীরেন সিংয়ের কোনও বন্ধঘর মিটিংয়ে রেকর্ড করা হয়েছিল। একজন হুইসেলব্লোয়ার সেটিকে প্রকাশ করেছেন। অভিযোগ, তাতে শোনা যাচ্ছে যে বীরেন সিং বলছেন, মৈতৈ গোষ্ঠীকে রাজ্যের অস্ত্রাগার লুট করতে দিয়েছিলেন তিনিই। এদিকে কোনও মৈতৈকে যাতে গ্রেফতার না করা হয়, তাও নিশ্চিত করেছিলেন বীরেন।
এদিকে এই অডিয়ো ক্লিপ সংক্রান্ত মামলার শুনানির শুরুতেই বিচারপতি সঞ্জয় কুমার জানিয়ে দেন, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন, তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের আয়োজিত একটি পার্টিতে অংশ নিয়েছিলেন। তবে ‘কুকি অর্গনাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটস’-এর হয়ে মামলা করা অ্যাডভোকেট প্রশান্ত ভূষণ জানিয়ে দেন, তাতে কোনও সমস্যা নেই। এদিকে আবেদনকারীদের দাবি, প্রকাশ্যে আসা এই অডিয়ো ক্লিপ থেকে স্পষ্ট যে ইচ্ছে করে মণিপুরে এই জাতিগত হিংসা শুরু করা হয়েছিল। আদালতের নজরদারিতে সিট গঠন করে তদন্তের আবেদন জানাচ্ছেন কুকিরা। এদিকে প্রশান্ত ভূষণ দাবি করেছেন, এই অডিয়ো ক্লিপটি ইতিমধ্যেই ট্রুথ ল্যাবকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, ভয়েস স্যাম্পেলের ৯৩ শতাংশই বীরেন সিংয়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তবে কেন্দ্রের তরফ থেকে এই মামলায় সওয়াল করা সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা দাবি করেন, ট্রুথ ল্যাবের রিপোর্টকে ধ্রুব সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায় না। এরপরই সিএফএসএল-কে এই অডিয়ো ক্লিপ পরীক্ষার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরেই মণিপুরে কুকি এবং মৈতৈ জনজাতির মধ্যে সংঘাত বজায় রয়েছে মণিপুরে। গত ২০২৩ সালের ৩ মে থেকে জাতিগত হিংসার সাক্ষী মণিপুর। মাঝে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত ছিল। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি অবস্থা। এখনও পর্যন্ত কয়েক হাজার জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চূড়াচাঁদপুর, মোরে, কাকচিং এবং কাংপোকপি জেলা থেকে অধিকাংশ মানুষকে সরানো হয়েছে। এরই মধ্যে হিংসায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রসঙ্গত, ইম্ফল উপত্যকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হল মৈতৈ জনজাতি। তবে তারা সম্প্রতি দাবি তুলেছিল যে তাদের তফসিলি উপজাতির তকমা দিতে হবে। তাদের এই দাবির বিরোধ জানিয়েছিল স্থানীয় কুকি-জো আদিবাসীরা। এদিকে হাই মণিপুর হাই কোর্টে এই নিয়ে মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় হাই কোর্ট নির্দেশ দেয়, মৈতৈদের নাম তফশিলি উপজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখুক রাজ্য। এই নির্দেশিকার পরই জো-কুকি সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রতিবাদে নামেন। এই আবহে ২০২৩ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে মণিপুরের অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন একটি মিছিলের আয়োজন করেছিল। সেই মিছিল ঘিরেই হিংসা ছড়িয়ে পড়ে চূড়াচাঁদপুর জেলায়। পরে অবশ্য হাই কোর্ট সংরক্ষণ নিয়ে নিজেদের সেই পর্যবেক্ষণ ফিরিয়ে নেয়।
তবে এখনও মণিপুরে হিংসার আগুন নেভেনি। এদিকে তফশিলি উপজাতির ইস্যুর পাশাপাশি সংরক্ষিত জমি এবং সার্ভে নিয়েও উত্তাপ ছড়িয়েছিল সেই রাজ্যে। এই আবহে গত ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসেই চূড়াচাঁদপুর জেলায় মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের সভাস্থলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ইন্ডিজেনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরামের সদস্যরা। এদিকে এই জেলা থেকে কুকি আদিবাসী বনাম মৈতৈদের এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য জেলাতেও। আর এখনও পর্যন্ত সেই হিংসা প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকশো সাধারণ মানুষ। বাফার জোন করে মৈতৈ এবং কুকিদের ভিন্ন এলাকায় রাখা হয়েছে। তার মধ্যেও মাঝে মাঝেই বাঁধছে সংঘাত। একে অপরের দিকে আঙুল তুলছে দুই জনজাতি।