মন চল নিজ নিকেতনে।
সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে, ভ্রম কেন অকারণে॥
বিষয় পঞ্চক আর ভূতগণ, সব তোর পর কেউ নয় আপন।
পর প্রেমে কেন হইয়ে মগন, ভুলিছ আপন জনে॥
অযোধ্যানাথ পাকড়াশির এই গান এক তরুণের কণ্ঠে শুনতে শুনতেই ভাবসমাধিস্থ হয়ে পড়লেন প্রেমের ঠাকুর, শ্রীরামকৃষ্ণ। রানি রাসমণির নির্মিত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কথা তখন সকলেই জানেন। আর কিংবদন্তির মতোই ততোধিক ছড়িয়ে পড়েছে এই কালীসাধকের নাম, শ্রীরামকৃষ্ণের নাম। শুধু মা কালী নন, ঈশ্বরনাম শ্রবণ করলেই তিনি দ্রবীভূত হয়ে পড়েন। হারিয়ে যান জন্মমৃত্যুর মানুষিক চরাচর থেকে। সেদিন গান ধরেছিলেন অবশ্য আরেক কিংবদন্তি — নরেন্দ্রনাথ। নরেন্দ্রনাথ দত্ত। সিমলার নরেন তখনও বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেননি। বাকি গানটিও শেষ করলেন নরেন্দ্রনাথ । —
সত্যপথে মন কর আরোহণ, প্রেমের আলো জ্বালি চল অণুক্ষণ।
সঙ্গেতে সম্বল রাখ পুণ্য ধন, গোপনে অতি যতনে॥
লোভ মোহ আদি পথে দস্যুগণ, পথিকের করে সর্বস্ব মোষণ।
পরম যতনে রাখ রে প্রহরী শম দম দুই জনে॥
সাধুসঙ্গ নাম আছে পান্থধাম, শ্রান্ত হলে তথা করিও বিশ্রাম।
পথভ্রান্ত হলে সুধাইও পথ সে পান্থ-নিবাসীহলে॥
যতি দেখ পথে ভয়েরি আকার, প্রাণপণে দিও দোহাই রাজার।
সে পথে রাজার প্রবল প্রতাপ, শমন ডরে যাঁর শাসনে॥
মন চল নিজ নিকেতনে
গানটি শুনে সেদিন এতই অভিভূত হয়ে পড়েন ঠাকুর যে, নরেন্দ্রনাথকে দক্ষিণেশ্বরে আমন্ত্রণ জানান। নরেন্দ্রনাথের গান শোনানো ও শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবসমাধিস্থ হওয়ার গোটা ঘটনাটিই ঘটে সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে। কথিত আছে, এখানেই নরেন্দ্রনাথ প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন পেয়েছিলেন। তবে এই দর্শন পাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল বেশ কিছু কাল আগে থেকেই। সেই ঘটনা না বললে দর্শনের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
নরেন্দ্রনাথের মনে কৌতুহল জাগে
জেনেরাল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনে ক্লাস করছেন নরেন। সাহিত্যের ক্লাস নিতে এলেন অধ্যাপক উইলিয়াম হেস্টি। সেদিনের পাঠ্য বিষয় উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘দ্য এক্সকারশন’। কবিতাটি পড়াতে পড়াতেই উঠে আসে রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রসঙ্গ। আসলে উক্ত কবিতায় ব্যবহৃত ‘trance’ কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উইলিয়াম ঠাকুরের প্রসঙ্গ টানেন। তিনি ছাত্রদের বলেন, ‘শব্দটির সত্যিকারের অর্থ বুঝতে হলে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখতে হবে।’ এই কথা শুনে নরেন্দ্রনাথের মনে কৌতুহল জাগে। রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখার জন্য তখন থেকেই মনের ভিতর ঔৎসুক্যের জন্ম হতে শুরু করে।
গান শোনামাত্রই ঘটল অলৌকিক ঘটনা
১৮৮১ সালের নভেম্বর মাস। এফ.এ. পরীক্ষা দোরগোড়ায়। এই সময় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় রামচন্দ্র দত্ত নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে গিয়ে হাজির হন সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ি। সেখানে তখন উপস্থিত স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁকে ধর্মোপদেশ দানের জন্য নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নরেন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে পড়েন ঠাকুরের বাণীর প্রতি। রামকৃষ্ণ পরমহংস তরুণ নরেন্দ্রনাথকে একটি গান গাইতে বলেন। অনুরোধ ফেলতে পারেননি নরেন। দারজ কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন, ‘মন চল নিজ নিকেতনে।’ আর গান শোনামাত্রই ঘটল অলৌকিক ঘটনা। ভাবসমাধিস্থ হলেন ঠাকুর। গুরু-শিষ্যের নতুন অ্যাখ্যানের জন্ম দিয়েছিল এই গান। সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ি থেকেই শুরু হয় বাঙালি সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক ধর্মপুরুষের পথ চলা, আরেক ধর্মপুরুষের হাত ধরে!