‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর পাঁচ মাসও কাটেনি। তারমধ্যেই আর এক প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানের তালিবান নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী শনিবার গভীর রাতে পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় দেশেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আফগান সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি পাকিস্তানি ফাঁড়ি ধ্বংস করেছে এবং সেগুলির দখল নিয়েছে। যার ফলে পাক-আফগান সীমান্তে ক্রমশ উত্তাপ বাড়ছে। আর এই ডুরান্ড লাইন বরাবর পাকিস্তানি ও আফগান সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের কেন্দ্রে রয়েছে ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ (টিটিপি)।
রবিবার আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালিবান সরকারের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, ডুরান্ড লাইন, অর্থাৎ আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে রাতভর সংঘর্ষে ৫৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়েছে। জাবিউল্লাহ মুজাহিদ রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে ইসলামাবাদকে সহিংস কট্টর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও করেছেন এবং দাবি করেছেন যে এই সন্ত্রাসীরা, যারা মূলত একাধিক দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ, তাদের কাবুলের কাছে হস্তান্তর করা হোক। অন্যদিকে, রাতভর আফগানিস্তান সীমান্তে তুমুল সংঘর্ষের পর হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। তারা জানিয়েছে, পাক সেনার হামলায় আফগান তালিবানের ২০০ জনের বেশি সেনা ও অন্যান্য যোদ্ধা নিহত হয়েছে। এছাড়াও আফগান হামলায় ২৩ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর দুই দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে সৌদি আরব ও কাতার। আর এই হামলার সূত্রে উঠেছে ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’-এর নাম। কারণ, গত বৃহস্পতিবার কাবুলে এয়ারস্ট্রাইক করে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান সদস্য ও টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদকে খতম করার লক্ষ্যে নেমেছিল। কিন্তু তাতে সফল না হলেও ৩০ জন জঙ্গিকে নিকেশ করেছে বলে জানায় পাক সেনা। এরপরেই পাল্টা পাকিস্তানে একের পর এক হামলা চালাতে শুরু করেছে আফগানিস্তান।
‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) কী ও কারা?
‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) হলো একটি জঙ্গি গোষ্ঠী। তারা পাকিস্তানি তালিবান নামেও পরিচিত। এটি মূলত আফগান-পাকিস্তান সীমান্তের উভয় দিকেই সক্রিয়। বর্তমান দুই দেশের সীমান্তে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই সংগঠন। পাকিস্তান অভিযোগ, আফগানের তালিবান সরকার টিটিপি সদস্যদের আশ্রয় দিচ্ছে, যারা পাকিস্তানে হামলা করছে। তবে ভারত সফরে এসে আফগান বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি পাকিস্তানের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আফগানিস্তানে টিটিপির একজন সদস্যও সক্রিয় নেই। বলে রাখা ভালো, ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বাইতুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ফেডারেল শাসিত উপজাতি এলাকার (এফএটিএ) বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীকে একত্র করে টিটিপি গঠিত হয়। এই গোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিকভাবে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আল-কায়েদা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এর জন্ম। এই গোষ্ঠীর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল-পাকিস্তান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং শরিয়ত আইনের চরমপন্থী ব্যাখ্যা অনুযায়ী একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

মার্কিন ড্রোন হামলায় বেশ কয়েকজন বড় নেতার মৃত্যুর পর এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি একসময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে বর্তমান নেতা নুর ওয়ালি মেহসুদের নেতৃত্বে ২০২০ সাল থেকে তারা আবার ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। মতাদর্শগত মিল থাকলেও টিটিপি ও আফগানিস্তানের তালেবান দুটি আলাদা সংগঠন। টিটিপির মূল লক্ষ্য হলো পাকিস্তানের সরকারকে সরিয়ে তাদের নিজস্ব মতাদর্শে একটি ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সেই উদ্দেশ্যে টিটিপি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর প্রায়ই হামলা চালায়। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে তালিবান ফের ক্ষমতায় আসার পর টিটিপি আরও শক্তিশালী হয়। পরে তালিবান সরকার পাকিস্তান ও টিটিপির মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করে। এর মাধ্যমে একটি স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধবিরতি হয় এবং টিটিপির বন্দিরা পাকিস্তান থেকে মুক্তি পায়। তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর টিটিপি আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা বাড়িয়ে দেয়।